রোহিঙ্গাদের আবাসন প্রকল্পের খরচ বাড়ছে

নির্ধারিত খরচে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে নেয়া আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পটি। জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের আবাসস্থল এবং জাহাজ বা ভেসেল এর নিরাপদ নেভিগেশনের নিমিত্তে দ্বীপ সনাক্তকারী লাইট হাউজ সহ ২২টি নতুন অঙ্গ প্রকল্পে যুক্ত হওয়াতে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ৭৮২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। দ্বীপ রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হচ্ছে। আর কাজগুলো পুরোপুরি সমাপ্ত করার জন্য আরো দুই বছর সময় চাওয়া হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাছে এবং প্রকল্পটি শেষ হবে নভেম্বর ২০২১।

তবে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের জন্য চারতলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তারা বলছেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী স্থানান্তরের বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে ওই ভবন নির্মাণের জন্য ঠিকাদারের সাথে চুক্তি করা যাবে না। প্রধান মন্ত্রী দপ্তরের আশ্রয়ণ ৩ প্রকল্পটির প্রস্তাবনা আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে ।

প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, এ দেশে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে; কিন্তু এখন স্থান সঙ্কুলান করা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত পাহাড়ি জমি ও বনাঞ্চল নষ্ট হচ্ছে। বলপূর্বক এসব রোহিঙ্গাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। কক্সবাজারে শরণার্থী রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা আছে। সব মিলিয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র কক্সবাজার হুমকির মুখে পড়েছে। নোয়াখালী থেকে এর দূরত্ব ২১ নটিক্যাল মাইল। এদের মধ্যে এক লাখ মিয়ানমার নাগরিককে নোয়াখালীর ভাসানচর এলাকায় স্থানান্তরের জন্য সরকারি অর্থায়নে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প ২০১৭ সালে বাস্তবায়ন শুরু করা হয়, যাতে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৩১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা ২০১৮ সালের নভেম্বরে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ২২টি নতুন অঙ্গ এই প্রকল্পে শেষ মুহূর্তে যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। ৭৮২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা ৩৩.৮৬ শতাংশ বাড়তি ব্যয় প্রস্তাব করায় প্রকল্পের মোট বাস্তবায়ন খরচ তিন হাজার ৯৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় উন্নীত হলো।

অনুমোদিত ডিপিপির তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গাদের এক লাখ পাঁচ হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রাম, এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউজ, ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া উপাসনালয়সহ দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ও বাসভবন নির্মিত হবে। প্রকল্পের নাম আশ্রয়ণ-৩। ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে আগামী ২০১৯ সালের নভেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। বলা হচ্ছে, বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বিশাল স্রোত দেশের নিরাপত্তা ও পরিবেশ দুটোর জন্যই হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও ভাসানচরের অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, নলকূপ, ওয়াচ টাওয়ার, বেড়া নির্মিত হবে। রোহিঙ্গাদের অসুবিধায় একটি মাইক্রোবাস, ১২টি মোটরসাইকেল, ২৩টি হিউম্যান হলার, ৪০টি ঠেলাগাড়ি, ৪৩টি ভ্যানগাড়ি ও আটটি হাইস্পিড বোট কেনা হবে। প্রকল্পের আওতায় গুদামঘর, ওয়াচ টাওয়ার, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং, বোট ল্যান্ডিং সাইট, রাডার স্টেশন, সোলার প্যানেল, জেনারেটর, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন নির্মিত হবে।

ব্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বলছে, পরামর্শকের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দ্বীপ রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হচ্ছে। এ ছাড়া গুচ্ছগ্রাম, শেল্টার স্টেশন নির্মাণ, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণ, ভূমি উন্নয়ন, শোর প্রটেকশন ওয়ার্ক, পরামর্শক ইত্যাদি অঙ্গের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে, ২২টি নতুন অঙ্গ যেমনÑ জেটি নির্মাণ, জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের জন্য ভবন নির্মাণ, কালভার্ট নির্মাণ, ছোট আকারের লেক খনন, আরসিসি র্বাম্প নির্মাণ, চুলা স্থাপন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ। অর্থ ব্যয় হয়েছে ৯৮ শতাংশ বা দুই হাজার ২৬৫ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের জন্য প্রস্তাবিত চারতলা ভিতবিশিষ্ট পৃথক ভবন এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রস্তাবিত চারতলা ভিতবিশিষ্ট পৃথক ভবন নির্মাণের সংস্থান সংশোধিত ডিপিতে রাখা যেতে পারে। তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী স্থানান্তরের বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে ওই ভবন নির্মাণের জন্য ঠিকাদারের সাথে চুক্তি করা যাবে না।

প্রকল্প পরিচালকের দেয়া পিইসিতে বলা হয়েছে, দ্বীপ রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হচ্ছে। এই বাঁধের উচ্চতা মূল ডিপিপিতে ছিল ৯ ফুট। পরামর্শক সংস্থা এইচআর ওয়ালিং ফোর্ডের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এই উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক বলেন, কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে যদি ভাসানচরে স্থানান্তর করা না-ও সম্ভব হয়, তাহলেও প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে যে ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তাতে সরকার চাইলে এই এলাকা অর্থনৈতিক জোন বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে। হারবার এলাকা থেকে মানুষ ও পণ্যবাহী গাড়ীগুলো বাঁধ অতিক্রম করার জন্য আরসিসি র‌্যাম্প নির্মাণ করা।

উপকূলীয় প্রতিরক্ষা বাঁধের পাশাপাশি সমুদ্র ভাঙ্গন প্রবণ এলাকায় অফ সোর প্রটেকশন এর ব্যবস্থা করা ।সমুদ্র জোয়ার থেকে রক্ষার জন্য শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা। ঝড় ও জলোচ্ছাসের প্রকোপ প্রশমনের জন্য দ্বীপের চারদিকে বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা। প্রশস্ত ম্যানগ্রোভা বনাঞ্চল তৈরির মাধ্যমে বাঁধে ঢাল করা হবে, যা ঘুণিঝড়কালীণ সময়ে ঢেউয়ের প্রকোপ হতে দ্বীপের ভূমি রক্ষা করবে।

পণ্য এবং মানুষ পরিবহনকারী জাহাজ বা কার্গো ভেসেল ল্যান্ডিং ক্রাফট ভিড়ানো জন্য ক্রেণ সুবিধাসহ বিদ্যমান ল্যান্ডিং প্যাড উপযোগী মেরিন ফ্যাসিলিটিসহ বার্থ বা জেটি পর্ষন্ত আরসিসি রাস্তা নির্মাণ করা। দ্বীপে জনবল ও মালমাল সহজে নিরাপদে উঠা-নামা করার লক্ষ্যে নির্ধারিত ল্যান্ডিং পয়েন্টের পশ্চিমে স্বল্প দৈর্ঘ্যওে চ্যানেল ড্রেজিং করার ক্ষেত্রে মেরিন ফেসিলিটিসহ হারবার ব্যবস্থা করা। অতিবৃষ্টি ও জলাবব্ধতা নিরসনে দ্বীপের অভ্যন্তওে জমে থাক বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের জন্য দ্বীপটি স্লোপ বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সুইসগেট সম্বলিত স্থায়ী ড্রেনেজ বা কালভার্ট ব্যবস্থা তৈরি করা। এছাড়া দ্বীপের মধ্যে প্রধান সড়ক বা সার্ভিস রোড তৈরি করা। প্রশাসিক ভবন, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের আবাসস্থল এবং হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। জাহাজ বা ভেসেল নিরাপদ নেভিগেশনের জন্য দ্বীপ সনাক্তকারী ল্ইাট হাউস নির্মাণ করা হবে।

আর এই উচ্চতা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে পল্লী প্রতিষ্ঠান উইংয়ের যুগ্ম প্রধান বলেন, প্রকল্পের আওতায় নির্মিত স্থাপনাগুলো রক্ষার্থে আনুমানিক এক হাজার ৭০২ একর এলাকা বেষ্টনী করে ৯ ফুট উচ্চতার বাঁধ দেয়া হয়েছে, যার উচ্চতা আরো ১০ ফুট বৃদ্ধির জন্য সংশোধিত ডিপিপিতে প্রস্তাব করা হয়। ভাসানচরের মোট প্রায় ১৩ হাজার একর এবং বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী জায়গা রয়েছে প্রায় ছয় হাজার ৪২৭ একর। ভবিষ্যতে ব্যবহারের উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে সমগ্র এলাকায় প্রয়োজনীয় উচ্চতার বাঁধ নির্মাণ করা লাগতে পারে। তাই আপাতত বাঁধের সি সাইড অংশের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে পুরো দ্বীপ ব্যবহারের উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে বাঁধের উচ্চতার বিষয়টি বিবেচনা করা শ্রেয় হবে। তবে সিদ্ধান্ত হয়, বিদ্যমান বাঁধের সম্পূর্ণ অংশের উচ্চতা ১৯ ফুট বৃদ্ধির সংস্থান রেখে প্রথমে সি সাইড অংশের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং পরে উত্তর দিকের অর্থাৎ দ্বীপের ভেতরের দিকের অংশের উচ্চতা বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে।

পরিকল্পনা কমিশনের মতামতে বলা হয়েছে, বাস্তবিক কারণেই প্রকল্পের মেয়াদ দু’বছর বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিছু কাজ বাকি আছে। পাশাপাশি বড় কাজ হলো বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট বাড়ানো হয়েছে। তাই এই কাজটা শেষ করতে সময় লাগবে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের জন্য প্রস্তাবিত চারতলা ভিতবিশিষ্ট পৃথক ভবন এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রস্তাবিত চারতলা ভিতবিশিষ্ট পৃথক ভবন নির্মাণের বিষয়টি প্রয়োজনীয়তার নিরিখে রাখার জন্য বলা হয়েছে। যদি রোহিঙ্গারা না আসে তাহলে এসবের প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ শর্তসাপেক্ষে ওই ভবন নির্মাণের বিষয়টি থাকবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *